এনোরেক্সিয়া নার্ভোসা একটি গুরুতর খাদ্য বিষয়ক মানসিক সমস্যা। সাধারণত মেয়েদের মধ্যেই বেশি দেখা যায় এটি। এই রোগের ফলে মানুষের মধ্যে ওজন বেড়ে যাওয়ার তীব্র ভয় সৃষ্টি হয়। তবে এর পাশাপাশি অন্যান্য উপসর্গও থাকতে পারে। এই রোগের ফলে শরীর ও মন উভয়ই প্রভাবিত হয় এবং চিকিৎসা না করা হলে মারাত্মক পরিণতি হতে পারে। আজকের ফিচারে থাকছে এনোরেক্সিয়া নার্ভোসা সম্পর্কে বিস্তারিত।
লক্ষণ
এনোরেক্সিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের কঠোরভাবে ডায়েট কন্ট্রোল করা এবং ক্ষুধার্ত থাকা সত্ত্বেও খাবার ত্যাগ করার মানসিক প্রবণতা তৈরি হতে পারে। এই রোগের লক্ষণগুলো হলো-
উল্লেখযোগ্য ওজন হ্রাস– এনোরেক্সিয়া নার্ভোসা রোগে আক্রান্ত রোগীদের উল্লেখযোগ্য হারে ওজন হ্রাস পায়। তবে এটি নির্ণয় করা কিছুটা কঠিন হতে পারে। কারণ সঠিক ওজনের বিষয়টি প্রতিটি ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে।
ডায়েট নিয়ে দুশ্চিন্তা – এ রোগে আক্রান্ত রোগীরা খাদ্যাভ্যাস, ডায়েট ও শরীরের আকার নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তিত থাকে। এই দুশ্চিন্তা থেকে ক্যালরি গুনে খাবার খাওয়া, চর্বি ও কম ক্যালরি যুক্ত খাবার খাওয়া, খাবারের পুষ্টিগুণ নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করা, অন্যের সাথে নিজের শরীরের তুলনা করা ইত্যাদি অভ্যাস দেখা দেয়।
শরীর সম্পর্কে বিকৃত ধারণা- এ রোগে আক্রান্ত রোগীরা শরীর সম্পর্কে অন্যরকম ধারনা রাখেন। যেমন, কম ওজন থাকার পরেও নিজেকে অতিরিক্ত ওজনের বলে মনে করেন।
খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন– খেতে না চাওয়া, ঘন ঘন খাবার এড়িয়ে চলা বা খেতে অস্বীকার করা, ক্ষুধা অস্বীকার করা বা না খাওয়ার অজুহাত তৈরি করা ইত্যাদি স্বভাব দেখা দিতে পারে। এছাড়াও কেউ কেউ ক্যালরি পোড়ানোর জন্য অতিরিক্ত ব্যায়াম করতে পারে। অনেক সময় তারা ইচ্ছাকৃতভাবে বমিও করে।
শারীরিক লক্ষণ– বিভিন্ন রকম অপুষ্টিজনিত শারীরিক লক্ষণ দেখা দিতে পারে, যেমন, ক্লান্তি, অনিদ্রা, মাথা ঘোরা, নখ পাতলা হওয়া ও ভেঙ্গে যাওয়া, চুলের আগা ফাটা ও পড়ে যাওয়া ইত্যাদি। এছাড়াও অনিয়মিত ঋতুস্রাব, কোষ্ঠকাঠিন্য, পেটে ব্যথা, নিম্ন রক্তচাপ, পানিশূন্যতা, হাত-পা ফুলে যাওয়া, ঠাণ্ডা সহ্য করতে না পারা, দাঁতের ক্ষয় ইত্যাদি দেখা দিতে পারে।
এনোরেক্সিয়া নার্ভোসা কেন হয়?
বিভিন্ন কারণে এনোরেক্সিয়া নার্ভোসা দেখা দিতে পারে। যেমনঃ
১) জৈবিক কারণ– বংশগত ভাবে পরিবারে পূর্বে যদি কারো এনোরেক্সিয়া নার্ভোসা থেকে থাকে, তবে এ রোগ দেখা দিতে পারে। তাছাড়া মস্তিষ্কে কোনো রাসায়নিক পরিবর্তন বা হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণেও এ রোগ দেখা দিতে পারে।
২) মানসিক কারণ– ইনসিকিউরিটি, উদ্বেগ ইত্যাদি কারণে এ রোগের উদ্ভব হতে পারে। এছাড়াও কোনো মানসিক আঘাত বা জীবনে কোনো বড় পরিবর্তনের ফলেও হতে পারে।
৩) সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব– পারিবারিক ও সামাজিক চাপ থেকেও এনোরেক্সিয়া নার্ভোসা দেখা দিতে পারে। সমবয়সীদের মধ্যে বিশেষ করে অল্পবয়সী মেয়েদের মধ্যে চিকন হওয়ার আকাঙ্ক্ষা অনেক সময় প্রতিযোগিতায় রুপ নেয় এবং তা থেকেও না খেয়ে চিকন হওয়ার স্পৃহা জেগে উঠে।
জটিলতা
১) পুষ্টির ঘাটতি- দীর্ঘদিন অপর্যাপ্ত খাদ্য গ্রহণের ফলে গুরুতর অপুষ্টি হতে পারে, যার ফলে প্রয়োজনীয় ভিটামিন এবং খনিজগুলির ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
২) হাড়ের ঘনত্ব ক্ষয়- অপর্যাপ্ত পুষ্টি, বিশেষত ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন ডি-এর অভাবের ফলে হাড়ের ঘনত্ব হ্রাস পেতে পারে, যা ফ্র্যাকচার ও অস্টিওপরোসিসের ঝুঁকি বাড়ায়।
৩) এন্ডোক্রাইন এবং হরমোনের ভারসাম্যহীনতা- এনোরেক্সিয়া নার্ভোসা মানুষের স্বাভাবিক হরমোনের কার্যকারিতা ব্যহত করে। মহিলাদের মাসিক অনিয়মিত হয় এবং পুরুষদের মধ্যে, এটি টেস্টোস্টেরনের মাত্রা হ্রাস করতে পারে।
৪) ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালেন্স- অপর্যাপ্ত খাওয়া দাওয়ার কারণে শরীরে প্রয়োজনীয় ইলেকট্রোলাইট এর অভাব দেখা দেয়। যা হার্ট ও পেশী সহ বিভিন্ন শারীরিক ক্রিয়াকলাপকে প্রভাবিত করতে পারে।
৫) দাঁত ও মুখের হাইজিন জনিত সমস্যা- অপুষ্টি এবং স্ব-প্ররোচিত বমি দাঁতের ক্ষয়, দাঁতের এনামেল ক্ষয় এবং মাড়ির রোগ সহ দাঁতের সমস্যা হতে পারে।
৬) এছাড়াও দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, মাল্টি অরগ্যান ফেইলিউর, রক্তশূন্যতা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়।
এনোরেক্সিয়া নার্ভোসা এর চিকিৎসা
১) গুরুতর ক্ষেত্রে, এনোরেক্সিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করতে, শরীরে সঠিক মাত্রায় পুষ্টির ঘাটতি মেটাতে এবং শারীরিক সমস্যাগুলো সমাধান করতে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হতে পারে।
২) শারীরিক চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিক সুস্থতার জন্যেও কাউন্সেলিং প্রয়োজন। খাবার সম্পর্কে ভয় কাটিয়ে তুলতে যথাযথ কাউন্সেলিংয়ের জুড়ি নেই। অনেক সময় রোগী ভাবতে পারে যে এটি কোনো রোগ নয়, তাই তার কোনো চিকিৎসা প্রয়োজন নেই। এই ভুলটি অবশ্যই ভাঙ্গাতে হবে।
৩) ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শ অনুযায়ী রোগীকে বোঝাতে হবে যে ঠিক কতটুকু পরিমাণ খাবার ও পুষ্টি তার শরীরের জন্য দরকার।
৪) এনোরেক্সিয়া কাটিয়ে তুলতে কোনো ওষুধের সেভাবে ভূমিকা নেই, তবে ওজন নিয়ে চিন্তা থেকে যদি হতাশা কাজ করে কিংবা অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা দেখা দেয়, তবে তা দূর করার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টি ডিপ্রেশনের ওষুধ সেবন করা যেতে পারে।
আশা করছি এনোরেক্সিয়া নার্ভোসা নিয়ে আপনাদের বিস্তারিত তথ্য জানাতে পেরেছি। এর উপসর্গগুলো দেখা দিলে দেরি না করে দ্রুত বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে হবে।
ছবিঃ সাটারস্টক
Comments
Post a Comment