মানুষের চোখ একটি জটিল ও সূক্ষ্ম অঙ্গ। পরিষ্কার দৃষ্টি বজায় রাখার জন্য এর স্বাস্থ্য বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চোখের অনেক রকম সমস্যার মধ্যে চোখের প্রেশার বৃদ্ধি একটি গুরুত্বপুর্ন ও জটিল রোগ। রক্তচাপ বৃদ্ধির মত চোখের চাপও বাড়তে পারে তবে চোখের এ চাপ মোটেও রক্তচাপের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়। চোখের এই প্রেশার বৃদ্ধিকে অকুলার হাইপারটেনশন বলে। সঠিক সময়ে এই রোগ চিকিত্সা না করা হলে গ্লুকোমার মত গুরুতর চোখের সমস্যা হতে পারে। চোখের মারাত্মক সব সমস্যার মধ্যে গ্লুকোমা অন্যতম, যার কারনে প্রতিদিন বিশ্বজুড়ে লাখো মানুষ চোখের দৃষ্টি হারাচ্ছে। আজকের আর্টিকেলে শেয়ার করছি চোখের অতিরিক্ত প্রেশার বা গ্লুকোমা কেন হয়।
ইন্ট্রাওকুলার প্রেশার কী
চোখের ভেতরের চাপকে ইন্ট্রাওকুলার প্রেশার (IOP) বলে। চোখের ভেতর এক ধরনের তরল জাতীয় পদার্থ আছে যা চোখের নির্দিষ্ট আকার আকৃতি বজায় রাখে এবং চোখের পুষ্টির জোগান দেয়। এই তরল চোখের ভেতরেই নির্দিষ্ট হারে তৈরী হয় ও নির্দিষ্ট পথ দিয়ে বের হয়ে এসে চোখের চাপের ভারসাম্য বজায় রাখে। সুস্থ চোখে, IOP একটি স্বাভাবিক সীমার মধ্যে থাকে, সাধারণত ১২ থেকে ২২ মিলিমিটার পারদ (mmHg) এর মধ্যে। যখন এই চাপ স্বাভাবিক সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন চোখের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। এছাড়াও চোখের স্বাভাবিক চাপ দিনের বেলায় পরিবর্তিত হতে পারে এবং ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে।
চোখের অতিরিক্ত প্রেশার বৃদ্ধির লক্ষণ
প্রাথমিক পর্যায়ে চোখের প্রেশার বৃদ্ধি পেলে হালকা ব্যাথা ছাড়া তেমন কোন উপসর্গ দেখা যায় না। যে কারনে নিয়মিত চোখের পরীক্ষা নিরীক্ষা করা জরুরী। তবে দিনে দিনে অবস্থার অবনতি হলে কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন,
- চোখের দৃষ্টি ঝাপসা বা অস্পষ্ট হতে পারে।
- চোখের মধ্যে ব্যথা, মাথাব্যথা এবং চোখের চারপাশে অস্বস্তিকর অনুভূতি হতে পারে।
- চোখে লালচে ভাব হতে পারে।
- কিছু ক্ষেত্রে রোগী আলোর দিকে তাকালে চারপাশে হ্যালোস বা রংধনুর মতো রিং লক্ষ্য করতে পারেন, বিশেষ করে রাতে এমন হতে দেখা যায়।
- চোখ শুধু সামনের দৃশ্য দেখতে পারে, পাশে বা সাইডের দৃশ্য দেখতে সমস্যা হয়।
গ্লুকোমা বৃদ্ধির কারণ
অতিরিক্ত অ্যাকুয়াস হিউমার উৎপাদন
চোখের অভ্যন্তরীণ তরল পদার্থকে অ্যাকুয়াস হিউমার বলে। কোনো কারণে এই তরলের উৎপাদন বেড়ে গেলে চোখের প্রেশার বাড়ে। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, বিভিন্ন রকম ব্রেইন টিউমার, চোখের সংক্রামক নানা রোগ ইত্যাদি কারণে অতিরিক্ত অ্যাকুয়াস হিউমারের উৎপাদন হতে পারে।
অকুলার হাইপারটেনশন
আই এরিয়ার ভেতর উৎপাদিত তরল ঠিকমত বের হতে না পারলে চোখের প্রেশার বেড়ে যেতে পারে। এই অতিরিক্ত চাপের ফলে চোখের মূল নার্ভ বা অপটিক নার্ভের ক্ষতি হয় যার ফলে অন্ধত্ব দেখা দিতে পারে।
চোখের প্রদাহ
কোনো রোগ বা প্রদাহের ফলে চোখের প্রেশার বেড়ে যেতে পারে। চোখের মাঝের অংশে যেকোনো ধরনের ইনফেকশন অথবা প্রদাহের ফলে চোখের প্রেশার বেড়ে যায়।
অনিয়ন্ত্রিত ঔষধ
কিছু কিছু ঔষধ যেমন কর্টিকোস্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ দীর্ঘ দিন ধরে ব্যবহার করলে চোখের প্রেশার বাড়তে পারে।
আঘাত
কোনো প্রকার আঘাতের কারণে চোখের তরল নিষ্কাশনের রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে চোখের প্রেশার বেড়ে যেতে পারে।
চোখের টিউমার
আই এরিয়ার ভিতরে বা চারপাশে টিউমার চোখের নিষ্কাশন ব্যবস্থা নষ্ট করে দিতে পারে, যার ফলে চোখের প্রেশার বেড়ে যেতে পারে।
বয়স
অনেক সময় বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে চোখের প্রেশার বাড়তে পারে।
চোখের প্রেশার বৃদ্ধির চিকিৎসা
চোখের প্রেশার বেড়ে গেলে অপটিক স্নায়ুর ক্ষতি রোধ করা এবং দৃষ্টিশক্তি রক্ষণ করাই এর চিকিৎসার মূল লক্ষ্য। বিভিন্ন উপায়ে এই চিকিৎসা করা সম্ভব।
ঔষধ এর মাধ্যমে
বিভিন্ন রকম চোখের ড্রপ, যেমন প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন অ্যানালগ, বিটা-ব্লকার, আলফা অ্যাগোনিস্ট এবং কার্বনিক অ্যানহাইড্রেজ ইনহিবিটর, তরল অ্যাকুয়াস হিউমারের উৎপাদন কমিয়ে বা এর নিষ্কাশন বাড়িয়ে IOP কমাতে সাহায্য করতে পারে।
লেজার থেরাপি
লেজার থেরাপির মাধ্যমে চোখের তরল নিষ্কাশনের পথে কোনো ত্রুটি থাকলে তা ঠিক করা যায়।
সার্জারি
ঔষধ ও লেজার থেরাপি অকার্যকর হলে বিভিন্ন উন্নত সার্জারির মাধ্যমে চোখের অতিরিক্ত প্রেশার কমানো যায়।
গ্লুকোমা প্রতিরোধে করণীয়
বয়স এবং জেনেটিক্সের মতো কিছু কারণে চোখের প্রেশার বাড়লেও তা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তবুও আরো যাতে না বেড়ে যায় সে ঝুঁকি কমাতে কিছু পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। যেমন,
১) নিয়মিত চোখের পরীক্ষা করালে প্রাথমিক পর্যায়ে IOP বৃদ্ধি সনাক্ত করা যায়। এতে সময়মত চিকিৎসা ব্যবস্থা শুরু করা যায়।
২) চোখের পরীক্ষার সময় টোনোমেট্রি ব্যবহার করে IOP পরিমাপ করা হয়। যদি IOP ক্রমাগত বাড়তে থাকে তাহলে ঘন ঘন পর্যবেক্ষনের প্রয়োজন হয়।
৩) চোখের চাপের পরিমাপ ঠিকমত আছে কিনা তা নির্ণয় করার জন্য একটি আল্ট্রাসাউন্ড প্রোব দিয়ে কর্ণিয়ার পুরুত্ব মাপা হয়। কর্নিয়া পাতলা হলে IOP এর রিডিং কম চাপ দেখায় ঠিক তেমনি কর্ণিয়ার পুরুত্ব বেশি হলে রিডিং বেশি চাপ দেখায়।
চোখের অতিরিক্ত প্রেশার উপসর্গহীন হতে পারে, তবে এ থেকে গ্লুকোমা ও দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে যা উপেক্ষা করা উচিত নয়। প্রাথমিক অবস্থায় সনাক্তকরণ এবং সঠিক চিকিৎসার জন্য নিয়মিত চোখের পরীক্ষা এবং সক্রিয় ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করার মাধ্যমে, চোখের উচ্চ রক্তচাপযুক্ত ব্যক্তিরা তাদের দৃষ্টি রক্ষা করতে পারে এবং চোখের সর্বোত্তম স্বাস্থ্য বজায় রাখতে পারে।
ছবিঃ সাটারস্টক।
The post চোখের অতিরিক্ত প্রেশার বা গ্লুকোমা কেন হয় এবং এর চিকিৎসা কী? appeared first on Shajgoj.
from Shajgoj https://ift.tt/MejrTZ0
Apsara Hossain
Comments
Post a Comment