মেডিকেল সায়েন্সেও এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা অন্যদের কাছে আষাঢ়ে গল্প মনে হবে। সিউডোসায়েসিস (Pseudocyesis) অর্থাৎ ফ্যান্টম বা ফলস প্রেগনেন্সি এমনই একটি ঘটনা যা শুনতে অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি! কনসিভ না করেও প্রেগনেন্সি টেস্ট পজিটিভ আর গর্ভধারণের সব উপসর্গও স্পষ্ট। কীভাবে সম্ভব? আজকের ফিচারটি এই ইন্টারেস্টিং টপিক নিয়ে।
ফ্যান্টম বা ফলস প্রেগনেন্সি কী?
এটি এমন এক ধরনের কন্ডিশন যেখানে গর্ভে বাচ্চা ছাড়াই একজন পেশেন্টের প্রেগনেন্সির সকল ধরনের উপসর্গ থাকবে। যেমন- প্রেগনেন্সি টেস্ট পজিটিভ আসা, বমি হওয়া থেকে শুরু করে পেট বড় দেখানো, বাচ্চার নড়াচড়া অনুভব করা এমনকি লেবার পেইন পর্যন্ত থাকতে পারে; কিন্তু বাচ্চা কিন্তু গর্ভে নেই! আসলে এই ঘটনাগুলো সে নিজে ফিল করে।
এর লক্ষণগুলো কী?
- অনিয়মিত মাসিক
- স্তন ব্যথা হওয়া এবং বড় হয়ে যাওয়া
- পেট বড় হয়ে যাওয়া
- বমি বমি ভাব
- ওজন বেড়ে যাওয়া
- মুড সুয়িং
- ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ আসা
- ঘন ঘন ক্ষুধা লাগা
- বাচ্চার নড়াচড়ার অনুভূতি বুঝতে পারা
- কিছু কিছু ক্ষেত্রে রক্তে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোনের মাত্রাও বৃদ্ধি পেতে পারে
ফ্যান্টম প্রেগনেন্সি বনাম নরমাল প্রেগনেন্সি
ফ্যান্টম প্রেগনেন্সির ক্ষেত্রে সেই নারীরা বিশ্বাস করেন যে তারা প্রেগনেন্ট এবং দাবি করেন যে তারা প্রেগনেন্সির সব উপসর্গগুলোই বুঝতে পারছেন। তারপরও এই ধরনের প্রেগনেন্সিতে নরমাল প্রেগনেন্সির মতো পজিটিভ এইচসিজি (HCG-Human Chorionic Gonadotropin) হরমোন টেস্ট দেখা যায়। যদিও অনেক সময় ঘরে স্ট্রিপ টেস্টে প্রেগনেন্সি ফলস পজেটিভ আসতে পারে, কিন্তু রক্তে এইচসিজি হরমোনের মাত্রা পরীক্ষার মাধ্যমে প্রেগনেন্সি নির্ণয় করা যায়। এটি এক ধরনের হরমোন যা গর্ভাবস্থায় গর্ভফুল বা প্লাসেন্টা দ্বারা উৎপাদিত হয়। নরমালি কনসিভ করার ১০ থেকে ১১ দিনের মধ্যে রক্তে এইচসিজি হরমোনের উপস্থিতি পাওয়া যায়। ফ্যান্টম প্রেগনেন্সিতেও এটি পজিটিভ আসে।
কারণ
১) বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেন যে বেশিরভাগ ফ্যান্টম বা ফলস প্রেগনেন্সি মানসিক ও শারীরিক কোনো প্রতিক্রিয়ার কারণে হয়ে থাকে। ইমোশনের কারণে হরমোনের লেভেল বেড়ে যায় এবং কিছু ক্ষেত্রে প্রেগনেন্সির মতো লক্ষণ দেখা দেয়।
২) মনোব্যাধি বা সাইকোসিস, সিজোফ্রেনিয়া ও বন্ধ্যাত্বের সমস্যায় ভুগলে বা সন্তান ধারণের তীব্র ইচ্ছা বা আবেগের ফলে এমনটি হতে পারে।
৩) পিটুইটারি গ্রন্থির টিউমারের ফলে অনেক সময় ব্রেস্ট থেকে লিকুইড নিঃসরণ হতে পারে, যার ফলেও অনেক সময় ফ্যান্টম প্রেগনেন্সির লক্ষণ দেখা দেয়।
৪) ওভারিতে বিশেষ কিছু টিউমার হলে অস্বাভাবিকভাবে এইচসিজি হরমোন নিঃসৃত হয় এবং পিরিয়ড মিস হয়, তখন আপনি প্রেগনেন্সি টেস্ট করলে পজেটিভ দেখাবে।
কাদের হতে পারে ফ্যান্টম প্রেগনেন্সি?
যেসব নারীরা গর্ভাবস্থায় তীব্র কষ্টের সম্মুখীন হয়েছেন, বা গর্ভাবস্থায় কোনো দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে ফ্যান্টম প্রেগনেন্সির ঝুঁকি বেশি। এছাড়াও,
১) যারা দীর্ঘদিন যাবত গর্ভধারণের চেষ্টা করে বারবার ব্যর্থ হচ্ছেন এবং চেষ্টা করতে করতে প্রজননক্ষম বয়সের শেষ পর্যায়ে আছেন, তাদের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটতে পারে।
২) যারা গর্ভধারণের ব্যাপারটিকে অতি মাত্রায় আবেগ দিয়ে চিন্তা করেন, তাদের ক্ষেত্রে এমনটি হতে পারে। গর্ভধারণ নিয়ে প্রবল ভীতিও কাজ করে কারো কারো মনে। সেই ভয় থেকেও মিথ্যে গর্ভধারণের মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
৩) কিছু কিছু মেডিসিন সেবনের ফলে দেহের প্রোল্যাক্টিন হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়, যার ফলে মিল্ক সিক্রেশন হতে পারে। এতেও অনেক সময় ফ্যান্টম প্রেগনেন্সির লক্ষণ দেখা দেয়।
৪) নিম্ন আর্থ-সামাজিক অবস্থার নারীদের মধ্যে এর প্রবণতা বেশি। সাধারণত পারস্পরিক সম্পর্কে নিরাপত্তাহীনতা বোধ করলে বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো সম্পর্ক সমাপ্তির শঙ্কা থাকলে এই ঘটনা ঘটতে পারে।
৫) যাদের ঘন ঘন মিসক্যারেজ হয় তাদের ক্ষেত্রে হতে পারে, একাধিক কন্যা সন্তানের পর পুত্র লাভের মনবাসনা থেকেও এমন হতে পারে।
ফলস প্রেগনেন্সির ট্রিটমেন্ট কী?
দুর্লভ হলেও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই ধরনের কেস দেখা যায়। এর কারণ হলো উন্নয়নশীল দেশে সন্তান ধারণের ক্ষমতার উপর একজন নারীর মর্যাদা অনেকটাই নির্ভর করে। যেহেতু ফ্যান্টম বা ফলস প্রেগনেন্সির সাথে সাইকোলজিক্যাল ইস্যু জড়িত, সেজন্য এ ধরনের রোগীদের খুব সাবধানে ও যত্নের সাথে চিকিৎসা দিতে হয়।
১) প্রথমেই রোগীকে বিভিন্ন রকম টেস্টের মাধ্যমে সত্য ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করতে হয়। যেমন- আল্ট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমে বাচ্চা /ভ্রূণ যে গর্ভে নেই সেটি দেখানো যেতে পারে।
২) এর পাশাপাশি তাকে এই নিশ্চয়তাও দিতে হবে যে তিনি মিথ্যে বলছেন না। তার শারীরিক, মানসিক বা হরমোনাল পরিবর্তনের মতো পরিস্থিতির কারণে তিনি প্রেগনেন্সির লক্ষণ অনুভব করছেন।
সাথে প্রয়োজন মেন্টাল সাপোর্ট
কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগীর পরিবার ধারণা করতে পারে যে রোগী হয়তো মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। অনেকে এটিকে প্যারানরমাল বা অলৌকিক ঘটনাও ভাবতে পারে। সেক্ষেত্রে তার পরিবারের সদস্যদের সঠিক তথ্য ও সর্বাত্মক মানসিক সহায়তা দিতে হবে। রোগীর এ সময়ে মেন্টাল সাপোর্টের প্রয়োজন। তিনি যেন মানসিকভাবে আঘাত না পায় আর বেশি ইমোশনাল না হয়ে যায়, সেদিকে সবারই খেয়াল রাখতে হবে।
তাহলে বুঝতে পারলেন, এই ধরনের ফলস প্রেগনেন্সির সাথে সাইকোলজিক্যাল ফ্যাক্টর জড়িত। তাই শারীরিক ও মানসিকভাবে তার ট্রিটমেন্ট প্রয়োজন। শরীরের কোনো অঙ্গে টিউমার বা অন্য কোনো সমস্যা আছে কিনা, পিরিয়ড কেন রেগুলার হচ্ছে না, এই প্রবলেমগুলো আইডেন্টিফাই করে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে হবে। আজ এই পর্যন্তই। ভালো থাকবেন।
ছবি- সাটারস্টক
The post ফ্যান্টম বা ফলস প্রেগনেন্সি | কনসিভ না করেও প্রেগনেন্সি টেস্ট পজিটিভ? appeared first on Shajgoj.
from Shajgoj https://ift.tt/x4hcMZt
Munia
Comments
Post a Comment