পিরিয়ডের জন্য মাসের কয়েকটা দিন শারীরিক বা মানসিক পরিবর্তনগুলো নিয়ে আমরা যে আগের চেয়ে কিছুটা সচেতন হয়েছি সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। তবে আমাদের সমাজব্যবস্থায় কর্মক্ষেত্রের নিয়ম-কানুনগুলো যেখানে প্রায় সবটাই পুরুষের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে, সেখানে নারীদেহের মধ্যে ঘটতে থাকা হরমোনের এই চক্রাকার পরিবর্তনগুলো কখনোই কি সেরকম গুরুত্ব পেয়েছে? উত্তরটা সবারই জানা।
তবে গত কয়েক দশকে নারীরা কর্মক্ষেত্রে যে ব্যাপকভাবে যুক্ত হয়েছেন, তা এই বিষয়গুলো নিয়ে মূলধারায় কথা বলার প্রয়োজনীয়তা সামনে নিয়ে এসেছে। কিন্তু বাইরে এগুলো নিয়ে কথা বলা বা সোচ্চার হওয়ার আগে নিজেকেও জানতে হবে নিজের দেহে প্রতিমাসে কী ধরনের হরমোনাল পরিবর্তন হয় আর সেই পরিবর্তনগুলোর সাথে কীভাবে কাজকর্মকে সামঞ্জস্যে রাখলে স্ট্রেস আমাদের গ্রাস করতে পারবে না, চলুন তাহলে আজকে সেই সম্পর্কেই জানা যাক!
পিরিয়ড সাইকেল বা মাসিক চক্র সম্পর্কে কতোটুকু জানি?
যখন পিরিয়ড নিয়ে কথা হয় অনেকেই হয়তো ভাবেন পিরিয়ডের ২টি পর্ব আছে, যখন ব্লিডিং হয় তখন একটা আর যখন ব্লিডিং হচ্ছে না তখন আরেকটা। কিন্তু আসলে নারীদেহের মাসিক চক্র চার ভাগে বিভক্ত। পর্বগুলো হলো-
- মেন্সট্রুয়াল পর্ব
- ফলিকুলার পর্ব
- ওভুলেটরি পর্ব
- লুটিয়াল পর্ব
নানারকম হরমোনের কারসাজিতে এই সময়ে ডিম্বাণু তৈরি হয় এবং অনিষিক্ত ডিম্বাণু শরীর থেকে রক্তপাতের মাধ্যমে বের হয়ে যায়। প্রত্যেক পর্বে আমাদের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের সাথে কীভাবে আমাদের প্রোডাক্টিভিটি ঠিক রাখা যায়, সেটি নিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা।
মেন্সট্রুয়াল পর্ব
এই পর্ব সাধারণত ১-৭ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়ে থাকে। এই সময়ে জরায়ুর লাইনিং টিস্যুর সাথে অনিষিক্ত ডিম্বাণু শরীর থেকে রক্তের সাথে বের হয়ে যায় ।শরীরের সব হরমোনের লেভেল অর্থাৎ ইস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরন হরমোন এসময় কম থাকে। এ কারণে এসময় আমাদের এনার্জি লেভেল, ফোকাস পাওয়ার, প্রোডাক্টিভিটি লেভেল-এই সবকিছুও লো থাকে। এসময়ে আমরা মানসিকভাবে শান্তি এবং নীরবতা পছন্দ করি, তাই এই সময়টায় একা করা যায় এরকম কাজগুলোকে ক্যালেন্ডারে রাখতে পারেন।
কোনো একটা প্রজেক্টের প্রুফ রিডিং করা, রিপোর্টগুলোতে চোখ বুলিয়ে নেওয়া বা স্ক্রিপ্টগুলোর উপরে কাজ করা। বাম ও ডান মস্তিষ্কের মধ্যে সমন্বয় এ সময়ে সর্বোচ্চ থাকে, তাই যেকোনো অ্যানালাইটিক্যাল কাজ করার জন্য সেরা সময় এটি। গত মাসে নিজের পার্ফরম্যান্স কেমন ছিলো সেটার একটি মূল্যায়ন করে নিতে পারেন এই সময়ে। যে প্রজেক্টে এখন কাজ করছেন সেখানে কি ধরনের পরিবর্তন বা কৌশল আনা দরকার সেগুলোও ভেবে নিতে পারেন। তবে এসময় অতিরিক্ত কাজের চাপ এড়ানোর চেষ্টা করুন, নিজেকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম দিন।
ফলিকুলার পর্ব
এই পর্ব সাধারণত ১৪ দিন দীর্ঘ হয়। এটি মাসিকের প্রথম দিন থেকেই শুরু হয় এবং ওভুলেশন পর্যন্ত চলতে থাকে। এ সময়ে মূলত ফলিকল স্টিমুলেটিং হরমোন নামে একটি হরমোন পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে ক্ষরিত হয়, যার প্রভাবে আস্তে আস্তে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন এই দুই ধরনের হরমোন বাড়তে থাকে।
এই সময়টায় ইস্ট্রোজেনের প্রভাবে আপনার শরীরে নতুনভাবে শক্তি সঞ্চারিত হতে থাকে। তাই ব্রেইনস্টর্মিং করার জন্য, নতুন প্রজেক্ট প্ল্যান করার জন্য এই সময়টা বেশ দারুণ। নতুন কিছু শেখার জন্য এটি খুব ভালো একটি সময়। বিভিন্ন ধরনের সৃজনশীল ও জটিল কাজগুলো এসময় শেষ করতে পারেন। যে প্রজেক্টটায় অনেকদিন ধরে হাত দেবেন দেবেন করেও শুরু করা হচ্ছে না সেটি শুরু করার জন্য একেবারে সঠিক সময় এই ফলিকুলার পর্ব।
ওভুলেটরি পর্ব
এই সময়টা হলো চক্রের একদম মধ্যবর্তী সময় যখন ডিম্বাণু বের হয়। ওভুলেশন খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে হয়ে থাকে তবে এর আগে এবং পরে হরমোনের প্রভাবে কিছু শারীরিক পরিবর্তন বোধ হতে পারে।
এসময় শুরুতে প্রোজেস্টেরন হরমোন কমতে থাকে এবং ওভুলেশনের পর তা বাড়তে থাকে। অন্যদিকে ইস্ট্রোজেন ও টেস্টোস্টেরন দুই হরমোন-ই এইসময় একদম সর্বোচ্চ অবস্থায় থাকে। তাই এই সময় কমিউনিকেশন আর কোলাবোরেশন করার জন্য সেরা সময়। কেননা, টেস্টোস্টেরনের প্রভাবে এসময় আপনি বেশি সামাজিক ও আত্মবিশ্বাসী বোধ করবেন। এই সময় আপনার যোগাযোগ ও সহযোগিতার দক্ষতা সারা মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি থাকে। এই পর্যায়ে আপনার হরমোনাল কেমিস্ট্রি আপনার মৌখিক দক্ষতা বাড়িয়ে তোলে। গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করার জন্য এটি একটি দুর্দান্ত সময়। তাই যেকোনো ধরনের ক্রিটিক্যাল মিটিং বা স্ট্র্যাটেজিক কাজের জন্য এই সময়টি পারফেক্ট।
লুটিয়াল পর্ব
১৫-২৮ তম দিনের লুটিয়াল পর্বে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন উভয়েরই মাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং পরবর্তীতে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। প্রোজেস্টেরনের প্রভাবে এসময় মন কিছুটা শান্ত অনুভব করে। এই সময়ই আমরা সবথেকে বেশি প্রোডাক্টিভ থাকি। মস্তিষ্ক এই সময়ে খুব সূক্ষ্মতার সাথে কাজগুলোকে সম্পন্ন করতে চায়। তাই কিছুটা স্লো ডাউন করে এইসময়ে কাজগুলোকে আরো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারেন।
এসময় কাজের দিকে ফোকাস করা সহজ হয়। কাজ শেষ করার পরিতৃপ্তি কাজ করে। তাই এসময়টায় কাজগুলো সম্পূর্ণ করার চেষ্টা করুন। যেসব কাজে ডিটেইলিং-এর দরকার হয় এবং বেশি ফোকাস করতে হয় এমন ধরনের কাজগুলো এই পর্বে করতে পারেন। অনেক নারীই এসময় পিএমএস বা প্রিমেন্সট্রুয়াল সিনড্রোমের কারণে বেশি আবেগপ্রবণ বোধ করেন। কাজেই, এটি মাসের সেই সময় যখন নিজের যত্ন নেওয়া এবং প্রশাসনিক কাজের মতো সহজ কাজগুলোতে মনোনিবেশ করা উচিত।
সারকথা
পিরিয়ড সাইকেল এর সাথে কাজের সমন্বয় করার অর্থ হলো মাসের যে সময়গুলোতে আমরা সবচেয়ে বেশি প্রোডাক্টিভ থাকি, সবচেয়ে ভালো ফোকাস করতে পারি-সেই সময়টা কাজে লাগানো। যদিও প্রোডাক্টিভিটি শুধু পিরিয়ড সাইকেল নয় বরং বাইরের পরিবেশ,মানসিক অবস্থা এসবের উপরেও অনেকাংশে নির্ভরশীল। মাসের পুরো সময়েই চেকলিস্টের কাজগুলো সবসময় সমান ধরনের হবে না এবং সবগুলো কাজের উপর টিক চিহ্ন পড়বে না- এই কথাটাও আমাদের মাথায় রাখতে হবে।
পিরিয়ড সাইকেল এর প্রতিটি পর্ব নিয়ে সঠিক ধারণা থাকলে সেটি আমাদের প্রোডাক্টিভিটি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গেইম চেঞ্জার হতে পারে। মেনস্ট্রুয়াল সাইকেলের পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করলে আপনার শরীরের শক্তি ও মনের অবস্থাকে কাজে লাগাতে পারবেন, যা কাজের মান ও গতিতে দারুণ পরিবর্তন আনতে পারে। সহজ কথায়, এই টেকনিক আপনার প্রোডাক্টিভিটির মঞ্চে যুক্ত করবে এক নতুন মাত্রা।
ছবি- সাটারস্টক, newhopefertility.com
The post পিরিয়ড সাইকেল এর সাথে নিজের প্রোডাক্টিভিটি কীভাবে ধরে রাখবেন? appeared first on Shajgoj.
from Shajgoj https://ift.tt/An51HWL
Munia
Comments
Post a Comment